গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে অতিষ্ঠ গ্রাহক

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীসহ সারাদেশে চলছে গ্যাস সংকট। বিশেষ করে সিএনজি স্টেশন এবং বাসা-বাড়ির গ্রাহকেরা পড়ছেন বেশি ভোগান্তিতে।

এদিকে, ঢাকায় বিদ্যুৎ সেবায় উল্লেখযোগ্য ঘাটতি না থাকলেও বাইরের জেলাগুলোতে চলছে ব্যাপক সংকট। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের তীব্র লোডশেডিংয়ের ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকেরা। কারণ খড়া মৌসুমে যথাসময়ে সেচ না পেলে, হুমকিতে পড়বে কৃষি আবাদ।

পিজিসিবির তথ্য অনুসারে, সোমবার দিনে বিদ্যুতের চাহিদা ছিলো ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ছিলো ১৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। বিপরিতে এদিন সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় হয়েছে ১২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর আগের দিন রোববার প্রায় একই চাহিদার বিপরীতে দিনে উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৮৮১ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ১৩ হাজার ৫৫৭ মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদন এবং চাহিদার মধ্যে রয়েছে বড় পার্থক্য।

যদিও গরমের প্রভাব কিছুটা কমায় এবং ঈদের ছুটিতে শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা অনেকটাই কমেছে। তবে বিদ্যুতের উৎপাদন না বাড়াতে পারলে, সামনে এই সংকট আরও বাড়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র জানায়, পিক সময়ে দেশে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ডিপিডিসি, ডেসকোর বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোডশেডিং-এর আওতায় বেশি রাখা হচ্ছে। তার মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। এ জন্য গ্রামগঞ্জে লোডশেডিংও বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নওগা, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রংপুরে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে।

নাটরে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা থাকছে না বিদ্যুৎ। রাতে লোডশেডিং হওয়ায় ভোগান্তি বাড়ছে সেহরি রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজে। এছাড়াও লোডশেডিংয়ের ফলে বোরো ধানসহ কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ারও শঙ্কা করা হচ্ছে।

নাটোর জেলা ক্যাবের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিতোষ কুমার অধিকারী বলেন, লোডশেডিংয়ের ফলে সেচ সমস্যা হলে ধান-পাটের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। তবে গরম কিছুটা কমায় লোডশেয়িংয়ের মাত্রা কিছুটা কমেছে।

নোয়াখালী ক্যাবের সভাপতি আমিনুজ্জামান মিলন বলেন, গ্রামে দিনে ২/৩ ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে আসে, কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যায়। পল্লী বিদ্যুৎ-পিডিবি দুই গ্রাহকেরই একই অবস্থা। কিন্তু পল্লী বিদ্যুতে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। তবে গ্রামের বাইরে থাকায় সোমবারের খবর জানি না।

নওগা ক্যাবের সভাপতি আজাদুল ইসলাম বলেন, জেলা সদরে একটু কম হলেও, গ্রামাঞ্চলে অন্তত ৬ থেকে ৭ ঘন্টা লোডশেডিং হচ্ছে।

স্থানীয় বিদ্যুত অফিসের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ১১ মেগাওয়াটের বদলে এখানকার গ্রাহক পাচ্ছেন ৭ থেকে ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

রংপুর ক্যাবের সভাপতি মো. আব্দুর রহমান বলেন, রংপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা নেসকোর সেবায় খুশি নন ভোক্তারা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ভয়াবহ লোডশেডিং হচ্ছে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে মানুষ।

হবিগঞ্জ ক্যাবের সভাপতি মো. দেওয়ান মিয়া বলেন, ৭ থেকে ৮ ঘন্টা লোডশেডিং হয়েছে। তবে গরম কমায় সোমবার একটু ভালো অবস্থা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু গরম বাড়লে কি হবে, সেটা বলা যাচ্ছে না।

লোডশেডিং থেকে মুক্তি পাচ্ছে না বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামও। চট্টগ্রামে যেখানে আগে দৈনিক গড়ে ৩০ থেকে ৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হতো, সেখানে তা বেড়ে এখন ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের গ্রাম এলাকায় দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের ঘটনাও ঘটছে।

চট্টগ্রামের বাসিন্দা ও ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দিনের অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুৎ থাকছে না। গড়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সময় বিদ্যুৎ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বেশি সমস্যা। তবে কিছু দিন আগে গ্যাসের সংকট থাকলেও এখন সেই সমস্যা কমেছে।

এদিকে, সিলেটে বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাসেও চলছে সংকট। বিশেষ করে গ্রামে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের খবরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন গ্যাস-বিদ্যুৎ গ্রাহক কল্যাণ পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ও সিনিয়র আইনজীবী নাসির উদ্দিন।

তবে বরিশাল ও মেহেরপুরসহ কিছু জেলায় লোডশেডিং কম রয়েছে। বরিশাল ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক রনজিত সরকার বলেন, শহর অঞ্চলে দিনে ২ থেকে ৩ ঘন্টা লোডশেডিং হচ্ছে। তবে গ্রামাঞ্চলে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।

এদিকে, দেশের দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজের জন্য বন্ধ রয়েছে। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহে কিছুটা সংকট চলছে। এছাড়াও গরমের কারণে চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও জ্বালানি সংকটে উৎপাদন বাড়াতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

আরইবি’র সদস্য (প্রশাসন) হাসান মারুফ বলেন, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। (ন্যাশনাল গ্রিড থেকে) আমাদের যা দেওয়া হচ্ছে আমরা সেটাই বিতরণ করছি। আর ঈদের ছুটি থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।

কিন্তু ছুটি শেষে কল কারখানা খুললে লোডশেডিং বাড়বে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটাতো আপনারাও বোঝেন। তবে আমাদের চেষ্টা রয়েছে- সেচ মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা দেয়ার।

সূত্রমতে, পতেঙ্গার এলএনজি টার্মিনালটি বন্ধ হওয়ার পর গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ কমেছে দৈনিক প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট। আর এই ঘাটতির কারণে সামগ্রিক ভাবে চাপ পড়েছে জ্বালানি খাতে। যার কারণ হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন করতে না পারাকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সদস্য ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, দেশীয় উৎপাদন না বাড়িয়ে সরকার চড়া দামের এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকেছে। এখন বিশ্ব বাজার থেকে বেশি দামে এলএনজি আমদানির কারণে সেই প্রভাব পড়ছে ভোক্তার উপর।

জানা যায়, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু বর্তমানে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে ২৫০ কোটি ঘনফুট। যার ফলে বিপুল পরিমাণ এ ঘাটতির প্রভাব দেখা যাচ্ছে শিল্প ও আবাসিক খাতে। বিশেষত আবাসিক পর্যায়ে গ্যাস সংকটের আকার ভয়াবহ।

বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, শনিআখড়া, মানিকনগর, কদমতলী, দয়াগঞ্জ, কাঁঠাল বাগান, কারওয়ান বাজার, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও মিরপুরসহ ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অনুন্নত এলাকাগুলোতে গ্যাসের বেশি সংকট রয়েছে।

যাত্রাবাড়ী এলাকার শারমিন বেগম বলেন, দিনে গ্যাসের চাপ থাকে না। যার কারণে রান্না করা যায় না। তাই খুব সকালে অথবা রাতে রান্না করতে হয়। কিন্তু ওই সময়তো সবাই একসঙ্গে রান্না করতে যায়, যে কারণে তখন সমস্যায় পড়তে হয়।

গ্যাস সংকটের একই কথা বলেন কাঠালবাগান এলাকার বিউটি বেগম। তিনি বলেন, সময়মতো গ্যাস না থাকার কারণে সিলিন্ডারও ব্যবহার করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক ও স্থানীয় বাসিন্দা মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, যাত্রাবাড়ী-শনিআখড়া এলাকায় সম্প্রতি ২ থকে ৩ ঘন্টা লোডশেডিং হয়েছে। সোমবার ছিলো। তবে রাতের পর থেকে এখনো বিদ্যুৎ যায়নি। আর এখন ঈদের ছুটি থাকায় লোডশেডিং কমেছে। কিন্তু শিল্প কারখানা খুললে গ্রাহকের ভোগান্তি বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাসের সংকট চলছে। বিশেষ করে দিনের বেলায় বাসা-বাড়িতে গ্যাসের চাপ একদমই থাকে না।

এদিকে, দেশে গ্যাসের সংকট সহসা কেটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অপরদিকে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় এলএনজি আমদানির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমান ডলার সংকটসহ নানা কারণে সেই সমাধানকেও অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।

এ বিষয়ে রাজধানীর গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চাহিদা মতো গ্যাস না পাওয়ায় পাইপে গ্যাসের চাপ কম থাকে। আর এমনিতেও বাসা-বাড়িতে গ্যাস সরবরাহের ইতিবাচক মানসিকতায় নেই কর্তৃপক্ষ। শিল্প কারখানাগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এর মধ্য থেকেই সর্বোচ্চটা দেয়ার। আর এখন (ঈদের ছুটি থাকায়) বাণিজ্যিক চাহিদা কম থাকায় আবাসিক খাতে সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, সরকারের ভুলনীতির কারণে দেশে জ্বালানি সংকট চলছে। আর এটা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে। কারণ তারা জ্বালানি খাতকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সেবা খাতকে বাণিজ্যিক খাতে পরিণত করেছে সরকার। তবে তারা তাদের ব্যর্থতা স্বীকার না করে বরং ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে প্রচার করছে। যেটা আরও বড় সমস্যা।

তিনি বলেন, জ্বালানি খাতের লাগামহীন লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে তার খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তাকে। কারণ প্রতিযোগীতামূলক বাজারকে প্রতিযোগীতাহীন করে ফেলায় খেয়াল খুশি মতো বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়াচ্ছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু সরকারের দায় মুক্তির আইনের কারণে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না। সরকারের বিশেষ আইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ-জ্বালানির নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির ক্ষমতাকে খর্ব করে রাখা হয়েছে। যদি সরবরাহকারী কোম্পানিকে জবাবদিহিতার আওতায় না আনা যায়, তাহলে ভোক্তা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

-এসএম